বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:০৫ পূর্বাহ্ন
◾ ওবায়দুর রহমান
মাধবী, মা বাবার একমাত্র মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই লেখা পড়ায় খুব ভালো। অবশ্য তার মা বাবা তার লেখা পড়া নিয়ে মোটেই খুশি নয়। কারণ পাশের বাসার ছেলেটা তার থেকে দশ নাম্বার বেশি পেয়েছে। কয়েক দিন হলো তার মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। সে জিপিএ ৫ পেয়েছে। মা বাবার একটাই সপ্ন ছিলো তার মেয়ে জিপিএ ৫ পাবে। যে ভাবেই হোক তার মেয়েকে জিপিএ ৫ পেতেই হবে। পরীক্ষার আগে মাধবী অমানবিক পরিশ্রম করে মা বাবার সপ্ন পূরণ করার জন্য। সারাদিন কোচিং, প্রাইভেট, স্কুল নিয়ে ব্যাস্ত সময় পার করছে মাধবী। বাসায় আসলেই মা পড়তে বসার জন্য চাপ দিতে থাকে। সারাদিন এই স্যার থেকে ওই স্যার। এই কোচিং থেকে ওই কোচিং করতে করতে শরীরটা খুব ক্লান্ত হয়ে পরের্ । বাসায় এসে পড়ার টেবিলে আর সায় দিতে চায়না । মাধবীর মনে বলে এখন যদি বিছানায় শরীরটা একটু এলিয়ে দেওয়া যেত, তবে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হতো। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব না কারণ একটু পরেই গণিত স্যার আসবে পড়াতে। মাধবীর মনে হয় তার জীবনটা কেমন জানি রোবটের মতো হয়ে যাচ্ছে। নেই কোন আরাম- আয়েশ, নেই কোন অবসর। সারাদিন শুধু পড়া আর পড়া। গণিত স্যার চলে গেলে আসবে ক্যামিস্ট্রির স্যর । তারপর ফিজিক্স ,ইংলিশ , ……। স্যারদের পড়ানো শেষ হলে মাধবীর নিস্তেজ দেহটাকে টেনে হিচরে পড়ার টেবিলে বসিয়ে দেয় মা। এভাবেই চলে মাধবীর দৈনন্দিন জীবন। তার পরীক্ষার সময় যত ঘনিয়ে আসে তার পড়া শোনার চাপ ততোই বাড়তে থাকে। একসময় তার পরীক্ষা শুরু হয় এবং সে সবগুলো পরীক্ষা খুব ভালোভাবে শেষ করে । ফলাফল প্রকাশিত হলে দেখা যায় সে জিপিএ ৫ পেয়েছে , এতে মা বাবা সহ গ্রামের সকলেই খুশি। এভাবে হাজারো মাধবী প্রতিনিয়ত জিপিএ ৫ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিষিয়ে তুলছে তাদের শিক্ষা জীবন। জিপিএ ৫ কে জীবনের লক্ষ গ্রহণ করে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে হাজারো তরুণ তরুণী।যে বয়সে তাদের মেধা বিকাশিত হওয়ার কথা নানা শৃজনশীল কর্মকান্ডের মাধ্যমে, সেই বয়সে তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে জিপিএ ৫ এর বীজ। তাদের মাথায় প্রোগ্রাম্ড করে দেওয়া হচ্ছে যে তাকে যে কোন মূল্যে জিপিএ ৫ পেতে হবে। জিপিএ ৫ না পেলে সে ভালো ছাত্র / ছাত্রী না। তথাকথিত ভালো শিক্ষার্থীর তকমা পেতে হলে তাকে জিপিএ ৫ পেতে হবে। পরিবার, পাশের বাসার আন্টি, সমাজের চাপে এই কোমল মতি শিক্ষার্থীরা একদম চিড়ে চ্যাপ্টা স্যান্ডুইচ হয়ে যাচ্ছে। তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে জিপিএ ৫ পাওয়ার মূল মন্ত্র। এতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন, জিপিএ ৫ অর্জন নয়। বর্তমানে শিক্ষার্থীরা জিপিএ ৫ এর পেছনে ছুটে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জিপিএ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের নোট,গাইড মুখস্থ করে তা উদগিরণ করে আসছে পরীক্ষার হলে। ফলে তারা প্রকৃত জ্ঞান অর্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমাদের সমাজ বার বার শিক্ষার্থীদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে তোমাকে জিপিএ ৫ পেতে হবে। জিপিএ ৫ না পেলে তুমি ব্যার্থ। সমাজ তোমাকে ব্যার্থ বলে আখ্যায়িত করবে। কিন্তু সমাজ কখনো এটা বলে না যে জিপিএ ৫ পাওয়ার আগে তোমাকে একজন ভালো মানুষ হতে হবে। শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে সমাজে একজন ভালো মানুষ হওয়া। একজন আদর্শবান মানুষ হয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করা। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মাথায় জিপিএ ৫ এর পোকা ঢুকিয়ে দিয়ে আদর্শবান মানুষ হওয়া থেকে তাদের বঞ্চিত করছি। এভাবে জিপিএ ৫ কে লক্ষ করে সামনের দিকে অগ্রসর হলে জাতি অপূরনীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। অন্ধকারের করাল গ্রাসে পতিত হবে জাতির ভবিষ্যত। জিপিএ ৫ এর জয় জয়কারে যখন চারপাশ মুখরিত হয় তখন একদল কোমল মতি শিক্ষার্থী যারা জিপিএ ৫ পায়নি হতাশার অতল গহব্বরে নিমজ্জ্বিত হচ্ছে। জিপিএ ৫ না পাওয়ার ব্যার্থতায় তাদের জীবন বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। জিপিএ ৫ না পাওয়ায় সমাজ তাকে ব্যার্থ নামক তকমা উপহার দিচ্ছে। সমাজ তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে জিপিএ ৫ না পেলে সে সফল নয়। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠা। কিন্তু শিক্ষা এখন হয়ে উঠেছে কেবল জিপিএ-৫ এর লক্ষ্য। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার চর্চা একেবারেই হচ্ছে না। আমাদের শিক্ষা আসলে আজকাল সার্টিফিকেটকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে যার কারণেই প্রকৃত মানুষ হওয়ার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে আমরা হয়ে যাচ্ছি ফলাফলকেন্দ্রিক। আর তখনই আমরা প্রত্যাশিত ফলাফল যখন পাচ্ছি না তখন বেছে নিচ্ছি আত্মহত্যার পথ। প্রত্যেক পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা যায় একদল শিক্ষার্থী যারা ফলাফল খারাপ করে বেছে নেই আত্বহত্যার পথ। ব্যার্থতার গ্লানি, সমাজের তাচ্ছিল্য, পরিবারের মানসিক চাপ এই কোমলমতি শিক্ষার্থীরা গ্রহণ করতে না পেরে অকালে বেছে নেই আত্বহত্যার পথ। অথচ এই শিক্ষার্থীরা বড় হয়ে একদিন সংসারের হাল ধরত। দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করতো।
আমাদের উচিত এসব কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ভালো মানুষ হতে উৎসাহ দেওয়া । তারা যেন এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে আসে এ ব্যাপারে তাদের সচেতন করা ।
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ফলাফলকেন্দ্রিক না হয়ে প্রকৃত উদ্দেশ্যের দিকগুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাগ্রত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের ভেতর নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। এর জন্য শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, পরিবার ও সমাজের মানুষের আরও সচেতন হতে হবে। যেন শিক্ষার্থীদের খারাপ ফলাফলের জন্য হেয়প্রতিপন্ন না করে তাদের মূল্যবোধের শিক্ষা দিয়ে থাকে। তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে।
আমরাই সমাজ গড়ার কারিগর, আমরাই দেশ গড়ার কারিগর। আর তাই এই সমাজে এই দেশকে গড়তে আমার আপনার সচেষ্ট হতে হবে সবার আগে।আমার আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারে সমাজের নিয়ম। শিক্ষা শব্দটা ফিরে পেতে পারে তার নিজস্ব সত্তা। ফলাফল বা জিপিএ-৫ নয়, শিক্ষা হোক মূল্যবোধ জাগ্রত হওয়ার। শিক্ষা হোক মনুষ্যত্ব বিকাশের, শিক্ষা হোক জ্ঞানার্জনের।
লেখক: ওবায়দুর রহমান
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা কলেজ ।